দখল-চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগ
অষ্টগ্রাম উপজেলা সভাপতি সাইদের অপকর্মে ইমেজ সংকটে স্থানীয় বিএনপি

ডেস্ক রিপোর্ট ::
কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলা বিএনপি সভাপতি সাইদ আহমেদ অপকর্মে ইমেজ সংকটে পড়েছে স্থানীয় বিএনপি। গত ৫ আগস্টের পর দলীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে সাইদ। তার অপর্কম ঠেকাতে জেলা বিএনপি থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও থেমে নেই তার অনিয়ম। এতে স্থানীয় বিএনপির ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। অষ্টগ্রাম স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেছেন, দলীয় নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আতঙ্কে রেখেছেন সাইদ। এছাড়াও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বয়ক ও তার পিতার বিরুদ্ধে মামলা করে প্রশাসনকে ব্যবহার করে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ অমান্য করে বিভিন্ন ভাবে দখলদারি, জলমহলের ইজারাদার কাছে থেকে চাঁদাবাজি, অবৈধ বালু উত্তোলন, কৃষির জমির মাটি বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অনিয়মের মাধ্যমে গত কয়েক মাসের ব্যবধানে অর্ধকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন সাইদ আহমেদ।
কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির কারণ দর্শানো (শোকজ) নোটিশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য সূত্রে জানা যায়, সৈয়দ সাঈদ আহমেদ অষ্টগ্রাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি পদে দায়িত্বে থেকে গত ৫ আগস্টে ছাত্র জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। গত ২৫ আগস্ট অষ্টগ্রাম উপজেলার মেঘনা নদীতে তার নেতৃত্বে অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের সময় সেনাবাহিনী তা জব্দ করে। বিভিন্ন মামলায় বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী, প্রবাসী ও নিরীহ জনসাধারণকে আসামি করে থানায় মামলা করেন তিনি। এছাড়াও অষ্টগ্রাম উপজেলা অটোমিশু সমিতির অনুমোদন দিয়েছেন দলীয় নিয়ম বহির্ভূতভাবে। গত ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস অষ্টগ্রামে কোনো কর্মসূচি পালন না করা অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে জানতে সৈয়দ সাঈদ আহমেদের মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, জেলা বিনএপি থেকে আমাকে নোটিশ দিয়েছে আমি জবাব দিয়েছি। এখানকার নেতাকর্মীরা সবাই টাউট ও বাটপার। পরে স্থানীয় নেতাকার্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা, জলমহলে চাঁদাবাজি, দখলদারি, অবৈধ বালু উত্তোলন, টাকা বিনিময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের মামলা থেকে দায়মুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি নোটিশের কি জবাব দিয়েছেন এবং জেলা বিএনপি তার জবাবে কি সন্তষ্টিমূলক বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল সেই কপিগুলো আপনার আছে কিনা জানতে চাইলে সাঈদ জানান, আমার কাছে কোনো কিছু নাই। এসময় ‘আরে মিয়া এতো কথা জিজ্ঞাসা করেন কেনা? এত সময় আছে নাকি আমার?’ বলে ফোন কেটে দেন তিনি।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মীর কামরুল হাসানের স্বাক্ষরে শোকজ ইস্যুকৃত নোটিশে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর ব্যাখ্যা দেন তিনি। এতে জেলা বিএনপি নেতাকর্মীরা অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু বিএনপির সিনিয়র নেতা অ্যাডভোকেট ফজলু হকের চাপের কারণে ওই ব্যাখ্যা জেলা বিএনপি নেতৃত্বেও কাছে সন্তষ্টিমূলক হয়েছে মর্মে দায়মুক্তি দেন বলে জেলা বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুঠোফোনে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, আমরা তাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছি। কিছু অনিয়ম হয়েছে। চেষ্টা করছি যাতে ঝামেলা না হয়। আশা করছি তেমন ঝামেলা হবে না। নোটিশের জবাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। পরে জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মীর কামরুল হাসান শামুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এ বিষয়ে অষ্টগ্রাম থানা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন বলেন, তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলি সত্য। ওনার এসব বিতর্কিত কর্মকান্ডে অষ্টগ্রামে মারাত্নক ইমেজ সংকটে পড়েছে বিএনপি। আমাদের দলের চরম ক্ষতি করছে সাইদ আহমেদ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। সর্বশেষ আমরা বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টার কাছে মৌখিক অভিযোগ দিয়েছি।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয় রেজওয়ান খান বলেন, আমার বাবা একসময় বিএনপির রাজনীতি করছেন। কিন্তু আপাতত কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত আক্রোশের জন্য পরপর ৩ টা মিথ্যা মামলায় বাবার নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন সাইদ আহমেদ। যেখানে আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করলাম, সেখানে প্রথম মামলায় আমার নামও ছিল। পরে থানায়, মেজর স্যারের সঙ্গে বিভিন্ন ভাবে কথা বলে আমার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। মামলাগুলোতে অসংখ্য সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকেও আসামি করা হয়েছে। বলতে পারেন অষ্টগ্রামে মামলা বাণিজ্য চলছে। অষ্টগ্রাম থানা সম্পূর্ণ রাজনৈতিকভাবে এখনও প্রভাবিত। সব বিষয়ে মানুষ ভয়ে কথাও বলে না। কারণ কথা বললেই যে কোনো রাজনৈতিক মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেবে।
একাধিক স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, অষ্টগ্রাম বিএনপি নেতা হান্নান ভূঁইয়া, ভূলন মেম্বার, বাচ্চু মেম্ববার, ইব্রাহিম চেম্বার, শাহাবুদ্দিনসহ শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলায় নাম দিয়েছেন সভাপতি সাইদ আহমেদ। শুধু মামলা দিয়ে ক্ষান্ত নয়, অষ্টগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিনকে দিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। মামলার কারণে এলাকায় ঢুকতে পারছেন না অনেকে। সাইদের অনিয়মের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলছে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। এক সভায় একটি হিন্দু পরিবারকে পিটিয়ে দেশ ছাড়া করা প্রকাশ্যে হুমকির ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরে, চ্যানেল আই টেলিভিশনসহ, একাধিক পত্রিকায় সংবাদ প্রচারিত হয়।
বিভিন্ন গণ্যমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যে জানা যায়, সাইদ আহমেদ এলাকায় একজন উগ্রপন্থী মানুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পলায়নের পরে ৩টি মামলা দায়ের করেন, এতে কয়েক শত আসামি করা হলেও, আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা যারা বিগত ১৬ বছর বিএনপিকে নির্যাতন করেছেন সেই প্রকৃত অপরাধীদের থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আসামি করা হয়নি। নিজের চাঁদাবাজি অপকর্ম ঢাকতে ও কন্ঠরোধ করতে, সরকারি চাকরিজীবী, দলীয় নেতাকর্মী, প্রবাসী, সাংবাদিক, জেলে থাকা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। অষ্টগ্রাম মেঘনা নদীর কয়েকটি স্থানে ৩টি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে লাখ লাখ টাকা লুটেপুটে নেন। এতে নদী তীরবর্তী গ্রামে সৃষ্টি হয় ভাঙন। দুই দফায় তার ১১জন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সড়কপথে চাঁদাবাজি করতে বিএনপির দলীয় প্যাডে অটোরিকশা চালক সমিতি গঠন করে, টাকা নিয়ে সরকারি সেচ প্রকল্পের ম্যানেজার/সভাপতি নিয়োগ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন অনুমোদন করেন। কর্মহীন, সংসার চালাতে অক্ষম এই দুর্নীতিবাজ নেতা বিএনপির নাম পরিচয়ের অপব্যবহার করে ৫ আগস্টের পর হঠাৎ অর্ধকোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। তার নিকট আত্মীয়ের নামে-বেনামে জমানো হয়েছে এসব অবৈধ টাকা।
সূত্র জানায়, গত ৫ আগষ্টের পর হাসিনা পলায়নের পর হতে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে অষ্টগ্রাম উপজেলা বিএনপি সভাপতি সাইদ আহমেদ (সাবেক ছাত্রশিবির নেতা) এলাকায় চাঁদাবাজি, জলমহাল, সেচপ্রকল্প ও জমি দখল এবং নিজ দলীয় নেতা-কর্মী, প্রবাসী, সরকারি চাকুরিজীবী, সাংবাদিকের নামে মামলা দায়ের করে, মামলা বাণিজ্যসহ উগ্র বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, বিভিন্ন প্রকল্পে নিজের আজ্ঞাবাহকদের মনোনীত করতে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। জোরপূর্বক পূর্ব অষ্টগ্রাম ইউনিয়নে কৃষি জমি দখল, মামলায় আসামি করার ভয় দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করা, গ্রামের মেলায় দোকানে চাঁদাবাজিসহ শত অভিযোগ রয়েছে এই নৈরাজ্যবাজ সভাপতির বিরুদ্ধে।
পূর্ব অষ্টগ্রাম ইউনিয়ন সেচ্ছাসেবক দলের নেতা মোঃ শাহাবুদ্দিনকে মামলার আসামি করে তার লিজ নেয়া মাছের ঘের দখল করে নেন সভাপতি। এবিষয়ে তিনি জানান, আমাকে মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়। আমাকে ঘর ছাড়া করে। এছাড়াও এলাকায় সবধরণের কাজে সাইদ আহমেদকে চাঁদা দিয়ে কাজ করতে হয়। তার অত্যাচারে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
বিলমাশকা জলমহলের ইজারাদার ব্যবসায়ী মোঃ রিমন মিয়াকে মামলায় দিয়ে তার জলমহল দখল নেয়। পরে ৪ লক্ষ টাকার চাঁদার বিনিময়ে তাকে জল মহল ফিরিয়ে দেয়। এ বিষয়ে ইজারাদার মোঃ রিমন মিয়া, পূর্ব অষ্টগ্রাম সাইদ আহমেদের এলাকায় আমরা ব্যবসায়ীরা বেশি হয়রানি শিকার হচ্ছি।
স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, সাইদের অকর্মের কারণে এলাকায় বিএনপিকে খারাপ চোখে দেখছে জনসাধারণ। ফলে আগামী নির্বাচনে ভোটার ও জনগণের নিকট ক্ষুণ্ন হচ্ছে বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের ভাবমূর্তি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের সুচিন্তিত মানবিক বাংলাদেশ গড়তে এই দুর্নীতিবাজ নেতাদের লাগাম টেনে না ধরলে বাধাগ্রস্থ হবে আগামীর বাংলাদেশ ও বিএনপি।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শরীফুল আলম বলেন, আমাদের দল সব সময় দখলবাজি, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রতিনিয়ত এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন। আমরা এসব বিষয়ে এলার্ট। অষ্টগ্রাম উপজেলা বিএনপি সভাপতি সাইদ আহমেদের অপকর্মের এবিষয়ে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।
উল্লেখ্য যে, বিগত চারদলীয় শাসনামলে শতাধিক পঙ্গু, প্রতিবন্ধী ও বিধবাদের ভাতা আত্মসাৎ এর মামলায় জেল খাটেন সাইদ। ২০০৯ সালের দিকে, পূর্ব অষ্টগ্রাম বিএনপি নেতা মাওলানা শাহ খুরশিদ আলমের চাঁদাবাজি মামলা কয়েক মাস জেল খাটেন সাইদ আহমেদ।