মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫ | চৈত্র ৪, ১৪৩১

মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫
চৈত্র ৪, ১৪৩১
এক টেন্ডারের মাধ্যমে ২০ লাখ হাওয়া

ময়মনসিংহ পাউবো'র নির্বাহী প্রকৌশলী জামিলের যত অভিযোগ

শাহাদত হোসেন

প্রকাশিত: ২০২৫-০১-২৮ ২১:০৩:৫৮

ডেস্ক রিপোর্ট ::

বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়মের বেড়াজালে বন্দি ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। সেখানকার নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উল জামিলের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তিনি এক টেন্ডারে মাধ্যমে ২০ লাখ টাকা হাওয়া করে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।  নিজের কমিশন বাণিজ্যের পাশাপাশি সরকারকে দিয়েছে রাজস্ব ফাঁকি।  স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের তৎকালিন দিনাজপুরের এমপি ইকবালুর রহমান ভাগ্নের হওয়ার সুবাদে ক্ষমতার অপব্যবহার করে  লুটপাট করে খেয়েছেন।  ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জেলার প্রতিটি প্রকল্পের টাকা। বনে গেছেন আঙ্গুল ফলে গাছ। ফ্যাসিবাদ আওয়ামীলীগ সরকারের দোসর হয়েও এখনো তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

অভিযোগ উঠেছে, বার বার তিনি বদলি হলেও ঘুরেফিরে ময়মনসিংহ জেলার দায়িত্বের রয়েছেন। এখানে তিনি মৌচাক এবং মধু খাচ্ছেন। বলেও অভিযোগ রয়েছে।  কৌশলে অর্থ আত্মসাৎ করে নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উল জামিল হাতিয়ে নেন সরকারের কোটি কোটি। কাজ না করে টাকা উত্তােলনেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এত এত অভিযোগের পরও বহাল তবিয়তে রয়েছে ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ড ( পাউবো)  এই  প্রকৌশলী । "যায়যায়দিনের" অনুসন্ধানের বেরিয়ে আসছে তার বিরোধে একের পর এক অভিযোগের পাহার।

প্রাপ্ত একটি টেন্ডারের তথ্যে জানা যায়, গত বছরের ০৯-সেপ্টেম্বর-২০২৪ ব্রহ্মপুত্র নদীর  বাঁধ নির্মাণে ১০০৮০৯৩নং টেন্ডার ওপেন করা হয়। টেন্ডারে দুটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেন। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ এ কাজের জন্য ৭ কোটি ৭৭ লাখ ৪০ হাজার ৬শ'৪৪ টাকার  টেন্ডার সাবমিট করেন। তার  বিপরীতে ঠিকাদার মো. নাসির উদ্দিন মোল্লা প্রতিষ্ঠান ৭ কোটি ৫৭ লাখ ৮৩ হাজার ৪শ' ৫৫টাকা টাকার টেন্ডার সাবমিট করেন। কিন্তু ১৯ লাখ ৫৭ হাজার ১শ'৮৯ টাকা টাকার পার্থক্য থাকলে।  ঠিকাদার মো. নাসির উদ্দিন মোল্লা না দিয়ে প্রকৌশলী জামিল কমিশন বাণিজ্য করে গুডম্যান প্রতিষ্ঠানিকে কাজ দেন। টেন্ডারটি  গত বছরের ১১/০৮/২০২৪ তারিখে  ক্লোজ করা হয় এবং ০৫-১২-২০২৪ তারিখে মেসার্স গুডম্যান এন্টারপ্রাইজকে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়। পরে গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠান নিজেরা একটা অংশ লাভ করে সেই কাজটি অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেয়।

সূত্র জানায়, পানি মন্ত্রণালয়  ২০২৩-২৪ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ময়মনসিংহ ডব্লিউডি বিভাগের অধীনে জেলা ময়মনসিংহের মরিচারচর উপজেলায় থেকে ঈশ্বরগঞ্জ উপেজলার পর্যন্ত কিমি.৭০.১২০ থেকে কিমি.৭০.৩৯০ = ২৭০ মি.পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর বাম তীর রক্ষামূলক কাজের কথা উল্লেখ্য রয়েছে। কাজটি এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু কাজ শুরু না করে  টাকা উত্তোলন করেছে বলে সূত্র জানিয়েছেন।

উপরোক্ত অভিযোগগুলোর বিষয়ে সরেজমিনে অনুসন্ধানে গেলে নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উল জামিল এ প্রতিবেদককে অর্থের মাধ্যমে ম্যানেজ করতে চান। ম্যানেজের অপচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ায় অভিযোগগুলোর কথা অস্বীকার করেন প্রতিবেদক কে লড়াইয়ের হুমকি দেন।

এবিষয়ে  ঠিকাদার মো. নাসির উদ্দিন মোল্লা  যায়যায়দিনকে বলেন,  ব্রহ্মপুত্র নদীর  বাঁধ নির্মাণে সরকারী ব্যয় প্রাক্কলন ৭ কোটি ৮১ লাখ ৩১ হাজার ৩শ' ১ টাকা চাওয়া হয়। কিন্তু এই টেন্ডারের সাড়ে ২৩ লাখ কম টেন্ডার সাবমিট করেও কাজটি পেলাম না। আমাদের টেন্ডার সাবমিটে কোনো প্রবলেম ছিল না। টেন্ডার ক্যাপাসিটি ছিলো আমাদের। টেন্ডারে যা যা চাওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ শর্ত মোতাবেক আমরা সাবমিট করেছি। আমাদের কাছ থেকে কমিশন চেয়েছিলেন প্রকৌশলী কিন্তু তার চাহিদা মতো রাজি না হওয়ায় আমাদের টেন্ডারটি দেয়া হয়নি।  এবিষয়ে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছি। প্রকৌশলী জামিল একজন প্রচন্ড ধৃত্য প্রকৃতির মানুষ। দেশের জনগণ ও সরকারের কথা না ভেবে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য কমিশন বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। লুটেপুটে খাচ্ছেন প্রকল্পের টাকা। এবিষয়ে গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কাউকে পাওয়া যায়নি।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, গত ২০২১ সনে ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডে যোগদান করেন আখলাক উল জামিল। যখনই বদলি আদেশ আসে  রহস্যজনক ভাবে ক্ষমতার প্রভাবে ময়মনসিংহ জেলার  দায়িত্বে থেকে যান । সর্বশেষ পাবনায় বদলি হয়ে গেলেও ঘুরেফিরে তিনি  ময়মনসিংহে এসেছেন। নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উল জামিল ছিলেন পুরো মাত্রায় আওয়ামিলীগের দোসর। তিনি একাধারে  ছিলেন দূর্নীতি ও আওয়ামিলীগ সরকারের ছিলেন প্রেজেন্টার। একাধিক স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য মতে,  পাউবোর ২০২৩- ২৪ অর্থ বছরের ময়মনসিংহ জেলার প্রায় সবকটি নদী খনন ও বাধঁ প্রকল্পের  অর্ধেকের কাজের আগেই তোলা হয়েছে টাকা।  বিভিন্ন সময়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার আগেই মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়াও তাঁদের বিরুদ্ধে আউটসোর্সিংয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগেও স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন বিভিন্ন সেচ ক্যানেল (জমি) লিজ দেওয়া বন্ধ থাকার পরও মৌখিক ও লিখিতভাবে অনুমতি দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে জানা যায়।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, আখলাক উল জামিল ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের আগেই ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ঠিকাদারের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা নেন কাজ দেওয়ার কথা বলে। নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের ঠিকাদারের কাছ থেকে নিজে যোগাযোগ করে টাকা নেন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারকে চাপ দিয়েও টাকা আদায় করেন তিনি।

যায়যায়দিনের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ময়মনসিংহ সবচেয়ে ভিআইপি প্রককৌশলী হলেন পাউবো আখলাক উল জামিল। তাকে সরকারি ফোনে পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে প্রশাসন ও গণ্যমাধ্যমকর্মীদের ম্যানেজ করতে তার রয়েছে নিজস্ব বাহিনী।

পানি  উন্নয়ন বোর্ডের ময়মনসিংহের একাধিক কর্মকর্তারা অভিযোগ জানিয়েছেন, টেন্ডার টেম্পারিংসহ অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে গুরুতর অসদাচরণ তার নিত্যদিনের কাজ। এছাড়াও সহকর্মীদের সঙ্গে বজায় রাখছে না শ্রদ্ধাচার। এ নিয়ে পানি  উন্নয়ন বোর্ডের ময়মনসিংহের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে  ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৌশলীর জামিলের প্রভাব আর ক্ষমতার কারণে চাকরিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না। এছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার নিজ এলাকাল দিনাজপুরে শত শত একর জমি নামে-বেনামে, বাগান বাড়ী, ঢাকায় একাধিক ফ্লাট কিনছেন। ৪ টি ফ্লাট বুকিং দিয়েছেন তিনি। হয়ে গেছেন টাকার কুমির। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের স্তুপ থাকলেও  সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ  রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না ।

এবিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, আমি মনে করি মাঠ পর্যায়ের পাউবো বা অন্য যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ঠেকাতে না পারলে সরকারের পরিকল্পনা ও প্রকল্পের কাজগুলো ভেস্তে যাবে।  তাই এখনই সময় যথাযথ সরকারি প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার আওতায় তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা । দুর্নীতিগ্রস্থ এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের আরো নজরদারি দরকার বলে আমি মনে করি।

অভিযোগগুলোর ব্যাপারে পাউবো (ইস্ট রিজিওন)  এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোঃ এনায়েত উল্লাহ যায়যায়দিনকে বলেন, পাউবোর কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতি ও প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্য করার কোনো সুযোগ নেই। কোনো কর্মকর্তারাই আইনের উর্দ্ধে নয়। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) মহাপরিচালক  প্রকৌশলী এ কে এম তাহমিদুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, অভিযোগটি হাতে পেয়েছি। অন্যায় করে কেউ পার পেয়ে যাবে না। সুদিনিষ্ঠ অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


SStv