সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫ | বৈশাখ ৮, ১৪৩২

সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫
বৈশাখ ৮, ১৪৩২

কক্সবাজার জেলা কারাগারে দূর্নীতি-নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র

শাহাদত হোসেন

প্রকাশিত: ২০২৫-০৩-১২ ১৯:১২:২৫

ডেস্ক রিপোর্ট ::

কক্সবাজার জেলা কারাগার এখন সংশোধনাগার নয়, বরং দুর্নীতি আর নির্যাতনের কেন্দ্র! জেলার আবু মুছার নেতৃত্বে এখানে টাকাই ন্যায়বিচার নির্ধারণ করে। ভালো সিট, মানসম্মত খাবার, এমনকি স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ—সবই কিনতে হয় মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে। আর যার টাকা নেই? তার জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ নির্যাতন, ডান্ডাবেরীর শেকল কিংবা ‘বুট-ছোলা চোর’ অপবাদ! কারা হাসপাতালও আর চিকিৎসার জায়গা নয়, বরং প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারিদের বিলাসবহুল বিশ্রামাগার। অসুস্থ বন্দিরা ন্যূনতম চিকিৎসার আশায় ছটফট করলেও, তাদের কপালে জোটে অবহেলা আর অবর্ণনীয় কষ্ট। আইনের শাসন এখানে কেবলই এক অলীক কল্পনা—বাস্তবে চলছে নিষ্ঠুর বাণিজ্য। অসহায় বন্দিরা টাকার বাজারে বিক্রি হচ্ছে, আর কর্তৃপক্ষ নির্বিকার! কারাগারের এই অন্ধকার গলিপথে মানবাধিকারের আলো কি কখনো পৌঁছাবে? এমন প্রশ্ন বন্দিদের। সম্প্রতি অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই কারাগারের ভয়ংকর এক বাস্তবতা।

গত ৩ মার্চ কারাগারের ভেতরে নির্মম এক ঘটনার জন্ম দেন জেলার আবু মুছা। বুট ও ছোলা চুরির অপবাদ দিয়ে ছয়জন হাজতিকে ক্যাশ টেবিলে ডেকে নিয়ে বেদড়ক মারধর করেন তিনি। সদ্য মুক্তি পাওয়া হাজতি শাহারিয়ার (হাজতি নম্বর ৫৯৭৯) জানান, অভিযুক্তরা সম্পূর্ণ নির্দোষ হলেও তাদের নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। মারধরের শিকার আসামিরা হলেন—মাতামুহুরী ২ নম্বর ওয়ার্ডের সুদে আলম (প্রকাশ লালু), আনোয়ার, মো. আলম, সৈয়দ আলম, নুরুল আমিন ও লতিফ। তারা এখনো কারাগারে বন্দি, যেকোনো সময় সত্যতা যাচাই করা সম্ভব।

সম্প্রতি বিনা অপরাধেও কয়েদিদের ডান্ডাবেরী পরানোর নজির রয়েছে! ফেব্রুয়ারি মাসে কারা ক্যান্টিনের লভ্যাংশের হিসাব গরমিল থাকার অজুহাতে ক্যান্টিনের চিফ রাইটারসহ ছয়জনকে ডান্ডাবেরী পরিয়ে সেলে আটকে রাখেন জেলার। এদের কাছ থেকে আদায় করা হয় দশ লাখ টাকা! অথচ, ডান্ডাবেরী দেওয়া হয় সাধারণত দাগি আসামিদের, কিন্তু কক্সবাজার কারাগারে এটি পরিণত হয়েছে চাঁদাবাজির অস্ত্রে! ডান্ডাবেরী পরানো হয়েছিল—ক্যান্টিন ইনচার্জ মুন্না, খাইরুল আমিন, রহমান, শফি আলম, জাফর, পিসি ইনচার্জ সাদেক ও হাবিবকে। পরে পাঁচজনের শেকল খুলে দেওয়া হলেও সাদেক ও হাবিব এখনো শেকলে বন্দি।

এখানে টাকার বিনিময়ে সব সুবিধা মিললেও, টাকা না থাকলে বন্দিদের ভাগ্যে জোটে নির্মম নির্যাতন। অভিযোগ আছে, কারাগারে হাসপাতালের সিট, খাবার, ফোনে কথা বলার সুযোগ—সবই এখন টাকার ওপর নির্ভরশীল। ওয়ার্ডে প্রথমবার ভর্তি হলে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা, আর প্রতিদিনের সরকারি মোবাইল ডিউটি ছাড়া কথা বলতে হলে গুনতে হয় ৫০০ টাকা প্রতি ১০ মিনিটে! নগদ টাকা থাকলে কক্সবাজার কারাগারে প্রতিদিনই কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়।

কারা হাসপাতালে অসুস্থ আসামি বা রোগী রাখার নিয়ম থাকলেও কক্সবাজার জেলা কারাগারে বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে হাসপাতালকে বানানো হয়েছে ইয়াবা কারবারি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের জন্য বিশেষ সেবা কেন্দ্র। কারারক্ষী মিজান জেলার আবু মুছার কাছ থেকে মাসিক চুক্তিতে কারা হাসপাতাল পরিচালনা করছেন। হাসপাতালে আসন দখল করে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের রাখা হয় এবং প্রতিজনের কাছ থেকে মাসিক ১৫-২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। বর্তমানে কারা হাসপাতালে ৪০-৪৫ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাদের কাছ থেকে প্রথমবার ভর্তি হওয়ার জন্যও ২০ হাজার টাকা নেওয়া হয়।

সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক মামলায় আসা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চলছে। বড়-ছোট নেতাদের জন্য ২০-৫০ হাজার টাকা ভর্তি ফি নেওয়া হয় এবং পরে মাসিক সিট ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১৫-২০ হাজার টাকা। যাদের সামর্থ্য কম, তারা ফ্লোরে থাকতে বাধ্য হন এবং সেখানেও মাসে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়।

কারা হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষী মিজান জেলার আবু মুছার অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি। যেসব ইয়াবা ব্যবসায়ী কারা হাসপাতালে থাকেন, তাদের কাছ থেকে প্রতিজন অগ্রিম ২০-৫০ হাজার টাকা এবং মাসিক ১৫-২০ হাজার টাকা কারারক্ষী মিজানের নেতৃত্বে আদায় করা হয়। ফলে প্রকৃত অসুস্থ বন্দিরা হাসপাতালে জায়গা পান না। কারাগারে সরকারি কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা কারা মহাপরিদর্শক পরিদর্শনে আসলে, এসব ইয়াবা ব্যবসায়ী বন্দিদের হাসপাতাল থেকে সরিয়ে কিছু সময়ের জন্য অন্য ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। ফলে পরিদর্শকদের কাছে কারা হাসপাতালের অবৈধ কার্যক্রম ধরা পড়ে না।

জেলার আবু মুছা কক্সবাজার কারাগারে যোগদানের পর থেকে কারাগারের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। দেশের সকল কারাগারে দীর্ঘদিন যাবত মহিলা দর্শনার্থীদের জন্য অফিস কল বন্ধ থাকলেও কক্সবাজার কারাগারে নিজের উদ্যোগে মহিলা দর্শনার্থীদের জন্য অফিস কল চালু করেছেন জেলার আবু মুছা। তবে এটি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে, শুধু ইয়াবা কারবারিদের আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। বর্তমানে এই কারাগারে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, গাঁজাসহ মরণনেশা আইস ও নানা রকমের মাদকদ্রব্য।

কারাগারে কয়েদি ও হাজতিদের ওপর নির্যাতন ও ডান্ডাবেরী পরানোর নিয়ম আছে কিনা, এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রাক্তন প্রধান ও মহাসচিব নূর খান লিটন বলেন, "বিনা অপরাধে কারাগারে কয়েদি বা হাজতিকে মারধর করা সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘন। জেলকোড অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, তবে শারীরিকভাবে আঘাত করা যাবে না।" এ বিষয়ে কক্সবাজার কারাগারের জেলার আবু মুছাকে তার মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

SStv